ঢাকা ০৬:০৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ বিজ্ঞপ্তী ::
সাপ্তাহিক যায় সময় পক্ষ থেকে লেখা আহবান

গল্প : পন্ডিত স্যার

  • আপডেট সময় : ০৭:৪৯:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৪
  • / ৬১ বার পড়া হয়েছে

পন্ডিত স্যার

মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম

শৈশবে দিনাজপুরে থাকাকালীন গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম। তৃতীয় শ্রেনি পাশ করার পর ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমি দিনাজপুর জেলা স্কুলে চতুর্থ শ্রেনিতে ভর্তি হই। তখনকার দিনে এখনকার মতো এতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। সরকারি স্কুল হিসেবে জেলা স্কুলই ছিল নামকরা। আমাদের বাড়ি থেকে জেলা স্কুলের দুরত্ব ছিল ৩ কিমি। প্রতিদিন কাঁধে বই নিয়ে হেঁটেই স্কুলে যাতায়াত করতাম। স্কুলের ড্রেস ছিল সাদা হাফ সার্ট এবং খাকি হাফ পেন্ট। সকাল দশটার সময় ক্লাস শুরু হয়ে শেষ হতো বিকাল পাঁচটায়। দুপুরে স্কুল থেকেই সরকারিভাবে টিফিন খাওয়ানো হতো।
চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তির কয়েকদিন আগে দিনাজপুর জেলা স্কুলে অধ্যয়নরত গ্রামের একজন বড়ভাই আমাকে জানায় যে, স্কুলের পন্ডিত স্যার না কী ছাত্রদের কাছে এক ভীতির কারণ। তাঁর নাম শুনলে সব ছাত্রদের বুক ভয়ে কেঁপে ওঠে।কোনো ছাত্র ক্লাসে পড়া না পারলে পন্ডিত স্যারের হাত থেকে তার আর রক্ষা নেই। তাকে কঠিন শাস্তি পেতেই হবে। তিনি বাংলা পড়ান। তাঁর অভিনব শাস্তির কথা ইতোমধ্যে বেশ ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই শাস্তির হাত থেকে বাঁচার জন্য ছাত্ররা পন্ডিত স্যারের পড়া ঠিকমতো করে যেত। কোনো ছাত্রই তাঁর অভিনব শাস্তি আর বেত্রাঘাতের মধ্যে পড়তে চাইতো না। পন্ডিত স্যারের এমন আচরণের কথা আমার মনে যথেষ্ট ভীতির সঞ্চার করে। আমি মনে মনে অস্বস্তিবোধ করতে থাকি। চিন্তায় রাতে ঠিকমতো ঘুম হতো না।
ভর্তির জন্য নির্ধারিত দিনে সকাল ৯ টার সময় আমার এক মামাসহ জেলা স্কুলের গেইটের সামনে পৌঁছাই। এক অজানা আশঙ্কা আর দুরুদুরু কাঁপা বুক নিয়ে স্কুলের গেইট পেরোতেই দারোয়ান আমাকে কাছে ডেকে চুপিসারে বলে, নতুন এসেছো। পন্ডিত স্যার থেকে সবসময় সাবধানে থাকবে। তাঁর ক্লাসের পড়া ঠিকমতো করে আসবে। কখনো তাঁর সামনে পড়বে না। পড়লেই স্যার পড়া ধরবেন। পারলে ভালো আর না পারলে ওই জায়গাতেই সবার সামনে তাৎক্ষনিক শাস্তি প্রদান করবেন। দারোয়ানের কথা শুনে আমি খুব ভয় পেয়ে একদম চুপসে যাই। ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপতে থাকে। আমার এহেন অবস্থা দেখে মামা বলেন, কী রে তুই এতো ঘাবড়ে গেছিস কেন? আমি মুখে জোর করে হাসি টেনে এনে বলি, কই না তো মামা? আমি একদম ঠিক আছি। তুমি খামোখা টেনশন করছো। আমার কথা শুনে মামা মুচকি হাসেন।
এসময়ে হঠাৎ দেখি স্কুলের ছাত্ররা ছুটোছুটি করে কে কোনদিকে পালাবে তার দিশা পাচ্ছে না। সবাই স্কুলের মাঠ ও বারান্দা ছেড়ে যার যার ক্লাসে ঢুকে পড়ছে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। আমি কৌতুহলী হয়ে উঠি। কী ব্যাপার! হঠাৎ হলো কী? আমি ও মামা রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। এসময়ে স্কুলে শোরগোল পড়ে যায়, ছাত্রদেরকে বলতে শোনা যায় – পন্ডিত স্যার আসছে, পন্ডিত স্যার আসছে। অনেকেই ক্লাস থেকে উঁকি মেরে স্কুল গেটের দিকে তাকিয়ে পন্ডিত স্যারকে দেখার অপেক্ষায় থাকে। আমি অবাক দৃষ্টিতে গেইটের দিকে তাকিয়ে দেখি, একজন লম্বা প্রকৃতির বয়স্ক ভদ্রলোক একটি সাইকেল চালিয়ে স্কুলের গেইট পরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করছেন। আশেপাশে থাকা কয়েকজন চাপাস্বরে বলতে থাকে, ওই যে পন্ডিত স্যার।
আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখি, পন্ডিত স্যারের বয়স পঞ্চাশ এর কাছাকাছি।পরণে সাদা রঙের ধুতি আর হলুদ গেরুয়া। একহারা গড়ন, লম্বায় ছ’ফুট। মাথার চুল পেকে ধবধবে সাদা হলেও ব্যাক ব্রাশ করা। পিছনে একটি বড় টিক্কি। ঠোটের উপর পাকা ছোট গোঁফ। কপালে সাদা তিলক আর গলায় পুঁথির মালা। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল। চেহারা রাশভারি এবং সবসময় ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে চলেন। কথা বলেন খুব ধীরে কিন্তু বজ্রকন্ঠে। তীব্র ও কঠোর চাহনির কারণে তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার মতো সাহস কারো হয়না। মুখে কোনো হাসি নেই। মনে হয় তিনি যেন হাসতে ভুলে গেছেন। ইতিমধ্যে আমি জেনেছি, পন্ডিত স্যার পড়াশোনার ব্যাপারে না কী ভীষণ কড়া প্রকৃতির এবং আচার-আচরণে খুবই কঠোর। ক্লাসের পড়া তিনি ক্লাসেই আদায় করে ছাড়েন। কেউ পড়া না পারলে তার কপালে জুটে কঠোর ভর্ৎসনা এবং অভিনব কায়দায় শাস্তি। যারা পড়া পারতো না, স্কুল ছুটি শেষে তিনি তাদেরকে বাড়ি যেতে না দিয়ে আলাদাভাবে এক্সট্রা ক্লাস নিয়ে পড়া আদায় করে তবেই ছাড়তেন। তার পড়ানোর কৌশল দেখে সবাই মুগ্ধ। এতো সুন্দর করে পড়ান যা শুনে ক্লাসের সবচেয়ে খারাপ ছাত্রটিও পড়া বুঝে যায়। ক্লাসের প্রতিটি ছাত্রকে আলাদাভাবে পড়া জিজ্ঞেস করে কেউ না পারলে পুনরায় পড়াতেন এবং ক্লাস শেষ হবার আগে সবার কাছ থেকে পড়া বুঝে নিতেন। কেউ পড়ালেখায় খারাপ করলে পন্ডিত স্যার তার অভিভাবককে স্কুলে ডেকে বিষয়টি জানাতেন।
স্কুলে ঢুকে পন্ডিত স্যার আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কটমট করে তাকিয়ে বলেন, কী রে ক্লাসে না গিয়ে এখানে হাবার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আর তোর পরণে স্কুল ড্রেস কোথায়? স্যারের এমন প্রশ্নে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। কী বলবো তা বুঝে উঠতে পারি না। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে মামা বিনয়ের সাথে বলেন, স্যার ওর নাম মির্জা। স্কুলে ভর্তি হতে এসেছে। ও তাই, একথা বলে আমাকে শাসন করতে না পেরে পন্ডিত স্যার বিরক্তির ভাব নিয়ে টিচার্সরুমে চলে যান। পন্ডিত স্যার যেতেই আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। আমার শরীর থেকে তখন ঘাম ঝরছিল। মনে মনে ভাবি, ওহ্! কী বাঁচাটাই না বেঁচেছি। তখনো ভর্তি হইনি। তা নাহলে কী অবস্থা যে হতো তা ভেবে মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। কারণ এর মধ্যে আমি জেনেছি যে, কেউ ইচ্ছে করে পন্ডিত স্যারের সামনে পড়ে না। পড়লে তার আর রক্ষে নেই। বাংলা ব্যাকারণ, রচনা ইত্যাদি ধরা আরম্ভ করবেন। পারলে ভালো, না পারলে অভিনব শাস্তি।
দিনাজপুর জেলা স্কুলে পড়ার সময়ের অনেক ঘটনার মধ্যে পন্ডিত স্যারের হাতে পিটুনি খাওয়ার কথা সর্বাগ্রে স্মৃতিপটে ভেসে আসে। এখন অবশ্য একথা কল্পনাও করা যায় না। পিটুনি তো দূরের কথা ধমক বা চোখ রাঙিয়েও কথা বলাও নিষেধ । কখনো এ এধরনের ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে জবাবদিহিতার মধ্যে পড়তে হয়। যা আমরা মাঝে মাঝে পত্রপত্রিকায় মাধ্যমে জানতে পারি। এক কথায় বলতে হয়, এখন স্কুল থেকে শাস্তি উঠেই গেছে। তাছাড়া পন্ডিত স্যারদেরও দেখা যায় না।
আমাদের সময়ে স্কুলে পড়া বলতে না পারলে স্যাররা যেসব শাস্তি দিতেন সেগুলো হলো কানমলে দেওয়া, গালে চড় মারা, কান ধরে বেঞ্চির ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা, কান ধরে ওঠা বসা, কান ধরে ক্লাসের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা, বকাবকি বা ভর্ৎসনা করা, কখনো বা কান ধরে স্কুলের মাঠে ঘোরানো ইত্যাদি। শাস্তির পরিমান বেশি হলে স্যাররা বেতের মাধ্যমে হাতে, পিঠে এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পেটাতেন। আগে অনেক স্যার বেত হাতে ক্লাসে আসতেন যা এখন আর দেখা যায় না।
তবে আমাদের পন্ডিত স্যারের শাস্তির ধরন ছিল একটু অন্যরকম। পড়া না পারলে তিনি হাতে বেত্রাঘাত করে স্কুলে সবার সামনে কান ধরে ঘোরাতেন। তার কাছে লঘু শাস্তি ছিল ক্লাস থেকে বের করে পুরো পিরিয়ড বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রাখা। স্যার ক্লাসে ছাত্রদের পড়তে বলে মাঝে মাঝে চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে থাকতেন। এই সুযোগে অনেকে পড়ায় ফাঁকি দিত। আর যাবে কোথায়? স্যার তাদেরকে ধরে ফেলতেন। আসলে ফাঁকিবাজ ছাত্রদের হাতে নাতে ধরার জন্য এটি ছিল পন্ডিত স্যারের একটি কৌশল। অনেক সময় স্যার সামনের দরজা দিয়ে না এসে পেছনের দরজা দিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করতেন। উদ্দেশ্য ক্লাস আরম্ভ হওয়ার পরেও পড়াশোনায় মনোযোগ না দিয়ে অহেতুক কোন ছাত্র কথা বলছে কী না? । একবার ধরা খেলে পরে কেউ আর কথা বলার সাহস পেত না। পন্ডিত স্যারের ভয়ে সবাই পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতো। এসব কথা অবিভাবকদের কানে গেলে তারা স্যারকে শান্তি প্রদানের জন্য উৎসাহ দিতেন। এখন অবশ্য এসব শাস্তির কথা চিন্তা করা যায় না এবং অভিভাবকরাও শাস্তি প্রদানের জন্য শিক্ষকদেরকে উৎসাহ প্রদান করেন না।
দিনাজপুর জেলা স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন আমিসহ কয়েকজন পন্ডিত স্যারের ক্লাসে পড়া ঠিকমতো বলতে পারিনি। ফলে যা হবার তাই হলো। স্যার আমাদেরকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়ে বাইরে স্কুলের মাঠ ঘুরিয়ে বারান্দায় দু’হাতে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, ক্লাসটি রাস্তা সংলগ্ন হওয়ায় ওই সময় আমার পাড়ার এক ছেলে পাশ দিয়ে যাবার পথে আমার এ করুন দৃশ্য দেখে খুব জোরে হাসতে হাসতে বলে, বড় ভাই আপনার এ কী অবস্হা?ছেলেটি বয়সে আমার চেয়ে ছোট। লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে যায়। মনে মনে ভাবি, সে তো পাড়ায় গিয়ে আমার এই করুন অবস্হার কথা অবশ্যই চারিদিকে রটিয়ে দেবে।
হলোও তাই, স্কুল শেষে বাড়ি ফেরার পথে পাড়ায় আমাকে দেখে অনেকেই মুখ টিপে হাসে। একজন তো একটু আগ বাড়িয়ে বলে, কী ভাই তুমি নাকি আজ ক্লাসে পড়া বলতে না পারায় স্কুলের মাঠ প্রদক্ষিণ করে বারান্দায় কান ধরে দাঁড়িয়ে ছিলে। শুনতে খুব খারাপ লাগলেও আমি কোনো মন্তব্য না করে মুখ কালো এবং মাথা নীচু করে বাড়ির পথে পা বাড়াই। পন্ডিত স্যারের শাস্তির কারণে যতটা মন খারাপ হয়নি তার চেয়ে ছেলেটির কথা ও অন্যান্যদের মুখ টিপে হাসাহাসিতে আমার মন খুব খারাপ হয়ে যায়। ভাগ্যিস এ খবর বাড়িতে পৌঁছেনি। এরপর থেকে পন্ডিত স্যারসহ অন্যান্য স্যারদের ক্লাসের পড়াশোনা ঠিকমতো করে যেতাম। যার ফলে আর কোনোদিন ওই ধরনের শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়নি।
অষ্টম শ্রেণি পাশ করে বাবার বদলিসূত্রে পাবনা জেলা স্কুলে আসার সময় পন্ডিত স্যার আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষন কেঁদেছিলেন। তাঁর মনের মধ্যে যে এতো দয়া আর মায়া তা আগে কখনোই বুঝতে পারিনি। আবেগ আর কান্নাজড়িত কন্ঠে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, পড়াশোনায় কখনও অমনোযোগী হবি না। ভালোমতো পড়াশোনা করবি। এ প্রসঙ্গে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, লেখাপড়া করে যে,গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে – কথাটি সবসময় মনে রাখবি। পন্ডিত স্যার আজ বেঁচে নেই। কিন্তু স্যারের কথা মনে পড়লেই হারিয়ে যাই স্মৃতির অতল তলে। দু’ চোখ মনের অজান্তেই ঝাপসা হয়ে আসে।
ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

গল্প : পন্ডিত স্যার

আপডেট সময় : ০৭:৪৯:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৪

পন্ডিত স্যার

মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম

শৈশবে দিনাজপুরে থাকাকালীন গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম। তৃতীয় শ্রেনি পাশ করার পর ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমি দিনাজপুর জেলা স্কুলে চতুর্থ শ্রেনিতে ভর্তি হই। তখনকার দিনে এখনকার মতো এতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। সরকারি স্কুল হিসেবে জেলা স্কুলই ছিল নামকরা। আমাদের বাড়ি থেকে জেলা স্কুলের দুরত্ব ছিল ৩ কিমি। প্রতিদিন কাঁধে বই নিয়ে হেঁটেই স্কুলে যাতায়াত করতাম। স্কুলের ড্রেস ছিল সাদা হাফ সার্ট এবং খাকি হাফ পেন্ট। সকাল দশটার সময় ক্লাস শুরু হয়ে শেষ হতো বিকাল পাঁচটায়। দুপুরে স্কুল থেকেই সরকারিভাবে টিফিন খাওয়ানো হতো।
চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তির কয়েকদিন আগে দিনাজপুর জেলা স্কুলে অধ্যয়নরত গ্রামের একজন বড়ভাই আমাকে জানায় যে, স্কুলের পন্ডিত স্যার না কী ছাত্রদের কাছে এক ভীতির কারণ। তাঁর নাম শুনলে সব ছাত্রদের বুক ভয়ে কেঁপে ওঠে।কোনো ছাত্র ক্লাসে পড়া না পারলে পন্ডিত স্যারের হাত থেকে তার আর রক্ষা নেই। তাকে কঠিন শাস্তি পেতেই হবে। তিনি বাংলা পড়ান। তাঁর অভিনব শাস্তির কথা ইতোমধ্যে বেশ ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই শাস্তির হাত থেকে বাঁচার জন্য ছাত্ররা পন্ডিত স্যারের পড়া ঠিকমতো করে যেত। কোনো ছাত্রই তাঁর অভিনব শাস্তি আর বেত্রাঘাতের মধ্যে পড়তে চাইতো না। পন্ডিত স্যারের এমন আচরণের কথা আমার মনে যথেষ্ট ভীতির সঞ্চার করে। আমি মনে মনে অস্বস্তিবোধ করতে থাকি। চিন্তায় রাতে ঠিকমতো ঘুম হতো না।
ভর্তির জন্য নির্ধারিত দিনে সকাল ৯ টার সময় আমার এক মামাসহ জেলা স্কুলের গেইটের সামনে পৌঁছাই। এক অজানা আশঙ্কা আর দুরুদুরু কাঁপা বুক নিয়ে স্কুলের গেইট পেরোতেই দারোয়ান আমাকে কাছে ডেকে চুপিসারে বলে, নতুন এসেছো। পন্ডিত স্যার থেকে সবসময় সাবধানে থাকবে। তাঁর ক্লাসের পড়া ঠিকমতো করে আসবে। কখনো তাঁর সামনে পড়বে না। পড়লেই স্যার পড়া ধরবেন। পারলে ভালো আর না পারলে ওই জায়গাতেই সবার সামনে তাৎক্ষনিক শাস্তি প্রদান করবেন। দারোয়ানের কথা শুনে আমি খুব ভয় পেয়ে একদম চুপসে যাই। ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপতে থাকে। আমার এহেন অবস্থা দেখে মামা বলেন, কী রে তুই এতো ঘাবড়ে গেছিস কেন? আমি মুখে জোর করে হাসি টেনে এনে বলি, কই না তো মামা? আমি একদম ঠিক আছি। তুমি খামোখা টেনশন করছো। আমার কথা শুনে মামা মুচকি হাসেন।
এসময়ে হঠাৎ দেখি স্কুলের ছাত্ররা ছুটোছুটি করে কে কোনদিকে পালাবে তার দিশা পাচ্ছে না। সবাই স্কুলের মাঠ ও বারান্দা ছেড়ে যার যার ক্লাসে ঢুকে পড়ছে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। আমি কৌতুহলী হয়ে উঠি। কী ব্যাপার! হঠাৎ হলো কী? আমি ও মামা রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। এসময়ে স্কুলে শোরগোল পড়ে যায়, ছাত্রদেরকে বলতে শোনা যায় – পন্ডিত স্যার আসছে, পন্ডিত স্যার আসছে। অনেকেই ক্লাস থেকে উঁকি মেরে স্কুল গেটের দিকে তাকিয়ে পন্ডিত স্যারকে দেখার অপেক্ষায় থাকে। আমি অবাক দৃষ্টিতে গেইটের দিকে তাকিয়ে দেখি, একজন লম্বা প্রকৃতির বয়স্ক ভদ্রলোক একটি সাইকেল চালিয়ে স্কুলের গেইট পরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করছেন। আশেপাশে থাকা কয়েকজন চাপাস্বরে বলতে থাকে, ওই যে পন্ডিত স্যার।
আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখি, পন্ডিত স্যারের বয়স পঞ্চাশ এর কাছাকাছি।পরণে সাদা রঙের ধুতি আর হলুদ গেরুয়া। একহারা গড়ন, লম্বায় ছ’ফুট। মাথার চুল পেকে ধবধবে সাদা হলেও ব্যাক ব্রাশ করা। পিছনে একটি বড় টিক্কি। ঠোটের উপর পাকা ছোট গোঁফ। কপালে সাদা তিলক আর গলায় পুঁথির মালা। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল। চেহারা রাশভারি এবং সবসময় ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে চলেন। কথা বলেন খুব ধীরে কিন্তু বজ্রকন্ঠে। তীব্র ও কঠোর চাহনির কারণে তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার মতো সাহস কারো হয়না। মুখে কোনো হাসি নেই। মনে হয় তিনি যেন হাসতে ভুলে গেছেন। ইতিমধ্যে আমি জেনেছি, পন্ডিত স্যার পড়াশোনার ব্যাপারে না কী ভীষণ কড়া প্রকৃতির এবং আচার-আচরণে খুবই কঠোর। ক্লাসের পড়া তিনি ক্লাসেই আদায় করে ছাড়েন। কেউ পড়া না পারলে তার কপালে জুটে কঠোর ভর্ৎসনা এবং অভিনব কায়দায় শাস্তি। যারা পড়া পারতো না, স্কুল ছুটি শেষে তিনি তাদেরকে বাড়ি যেতে না দিয়ে আলাদাভাবে এক্সট্রা ক্লাস নিয়ে পড়া আদায় করে তবেই ছাড়তেন। তার পড়ানোর কৌশল দেখে সবাই মুগ্ধ। এতো সুন্দর করে পড়ান যা শুনে ক্লাসের সবচেয়ে খারাপ ছাত্রটিও পড়া বুঝে যায়। ক্লাসের প্রতিটি ছাত্রকে আলাদাভাবে পড়া জিজ্ঞেস করে কেউ না পারলে পুনরায় পড়াতেন এবং ক্লাস শেষ হবার আগে সবার কাছ থেকে পড়া বুঝে নিতেন। কেউ পড়ালেখায় খারাপ করলে পন্ডিত স্যার তার অভিভাবককে স্কুলে ডেকে বিষয়টি জানাতেন।
স্কুলে ঢুকে পন্ডিত স্যার আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কটমট করে তাকিয়ে বলেন, কী রে ক্লাসে না গিয়ে এখানে হাবার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আর তোর পরণে স্কুল ড্রেস কোথায়? স্যারের এমন প্রশ্নে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। কী বলবো তা বুঝে উঠতে পারি না। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে মামা বিনয়ের সাথে বলেন, স্যার ওর নাম মির্জা। স্কুলে ভর্তি হতে এসেছে। ও তাই, একথা বলে আমাকে শাসন করতে না পেরে পন্ডিত স্যার বিরক্তির ভাব নিয়ে টিচার্সরুমে চলে যান। পন্ডিত স্যার যেতেই আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। আমার শরীর থেকে তখন ঘাম ঝরছিল। মনে মনে ভাবি, ওহ্! কী বাঁচাটাই না বেঁচেছি। তখনো ভর্তি হইনি। তা নাহলে কী অবস্থা যে হতো তা ভেবে মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। কারণ এর মধ্যে আমি জেনেছি যে, কেউ ইচ্ছে করে পন্ডিত স্যারের সামনে পড়ে না। পড়লে তার আর রক্ষে নেই। বাংলা ব্যাকারণ, রচনা ইত্যাদি ধরা আরম্ভ করবেন। পারলে ভালো, না পারলে অভিনব শাস্তি।
দিনাজপুর জেলা স্কুলে পড়ার সময়ের অনেক ঘটনার মধ্যে পন্ডিত স্যারের হাতে পিটুনি খাওয়ার কথা সর্বাগ্রে স্মৃতিপটে ভেসে আসে। এখন অবশ্য একথা কল্পনাও করা যায় না। পিটুনি তো দূরের কথা ধমক বা চোখ রাঙিয়েও কথা বলাও নিষেধ । কখনো এ এধরনের ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে জবাবদিহিতার মধ্যে পড়তে হয়। যা আমরা মাঝে মাঝে পত্রপত্রিকায় মাধ্যমে জানতে পারি। এক কথায় বলতে হয়, এখন স্কুল থেকে শাস্তি উঠেই গেছে। তাছাড়া পন্ডিত স্যারদেরও দেখা যায় না।
আমাদের সময়ে স্কুলে পড়া বলতে না পারলে স্যাররা যেসব শাস্তি দিতেন সেগুলো হলো কানমলে দেওয়া, গালে চড় মারা, কান ধরে বেঞ্চির ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা, কান ধরে ওঠা বসা, কান ধরে ক্লাসের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা, বকাবকি বা ভর্ৎসনা করা, কখনো বা কান ধরে স্কুলের মাঠে ঘোরানো ইত্যাদি। শাস্তির পরিমান বেশি হলে স্যাররা বেতের মাধ্যমে হাতে, পিঠে এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পেটাতেন। আগে অনেক স্যার বেত হাতে ক্লাসে আসতেন যা এখন আর দেখা যায় না।
তবে আমাদের পন্ডিত স্যারের শাস্তির ধরন ছিল একটু অন্যরকম। পড়া না পারলে তিনি হাতে বেত্রাঘাত করে স্কুলে সবার সামনে কান ধরে ঘোরাতেন। তার কাছে লঘু শাস্তি ছিল ক্লাস থেকে বের করে পুরো পিরিয়ড বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রাখা। স্যার ক্লাসে ছাত্রদের পড়তে বলে মাঝে মাঝে চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে থাকতেন। এই সুযোগে অনেকে পড়ায় ফাঁকি দিত। আর যাবে কোথায়? স্যার তাদেরকে ধরে ফেলতেন। আসলে ফাঁকিবাজ ছাত্রদের হাতে নাতে ধরার জন্য এটি ছিল পন্ডিত স্যারের একটি কৌশল। অনেক সময় স্যার সামনের দরজা দিয়ে না এসে পেছনের দরজা দিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করতেন। উদ্দেশ্য ক্লাস আরম্ভ হওয়ার পরেও পড়াশোনায় মনোযোগ না দিয়ে অহেতুক কোন ছাত্র কথা বলছে কী না? । একবার ধরা খেলে পরে কেউ আর কথা বলার সাহস পেত না। পন্ডিত স্যারের ভয়ে সবাই পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতো। এসব কথা অবিভাবকদের কানে গেলে তারা স্যারকে শান্তি প্রদানের জন্য উৎসাহ দিতেন। এখন অবশ্য এসব শাস্তির কথা চিন্তা করা যায় না এবং অভিভাবকরাও শাস্তি প্রদানের জন্য শিক্ষকদেরকে উৎসাহ প্রদান করেন না।
দিনাজপুর জেলা স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন আমিসহ কয়েকজন পন্ডিত স্যারের ক্লাসে পড়া ঠিকমতো বলতে পারিনি। ফলে যা হবার তাই হলো। স্যার আমাদেরকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়ে বাইরে স্কুলের মাঠ ঘুরিয়ে বারান্দায় দু’হাতে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, ক্লাসটি রাস্তা সংলগ্ন হওয়ায় ওই সময় আমার পাড়ার এক ছেলে পাশ দিয়ে যাবার পথে আমার এ করুন দৃশ্য দেখে খুব জোরে হাসতে হাসতে বলে, বড় ভাই আপনার এ কী অবস্হা?ছেলেটি বয়সে আমার চেয়ে ছোট। লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে যায়। মনে মনে ভাবি, সে তো পাড়ায় গিয়ে আমার এই করুন অবস্হার কথা অবশ্যই চারিদিকে রটিয়ে দেবে।
হলোও তাই, স্কুল শেষে বাড়ি ফেরার পথে পাড়ায় আমাকে দেখে অনেকেই মুখ টিপে হাসে। একজন তো একটু আগ বাড়িয়ে বলে, কী ভাই তুমি নাকি আজ ক্লাসে পড়া বলতে না পারায় স্কুলের মাঠ প্রদক্ষিণ করে বারান্দায় কান ধরে দাঁড়িয়ে ছিলে। শুনতে খুব খারাপ লাগলেও আমি কোনো মন্তব্য না করে মুখ কালো এবং মাথা নীচু করে বাড়ির পথে পা বাড়াই। পন্ডিত স্যারের শাস্তির কারণে যতটা মন খারাপ হয়নি তার চেয়ে ছেলেটির কথা ও অন্যান্যদের মুখ টিপে হাসাহাসিতে আমার মন খুব খারাপ হয়ে যায়। ভাগ্যিস এ খবর বাড়িতে পৌঁছেনি। এরপর থেকে পন্ডিত স্যারসহ অন্যান্য স্যারদের ক্লাসের পড়াশোনা ঠিকমতো করে যেতাম। যার ফলে আর কোনোদিন ওই ধরনের শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়নি।
অষ্টম শ্রেণি পাশ করে বাবার বদলিসূত্রে পাবনা জেলা স্কুলে আসার সময় পন্ডিত স্যার আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষন কেঁদেছিলেন। তাঁর মনের মধ্যে যে এতো দয়া আর মায়া তা আগে কখনোই বুঝতে পারিনি। আবেগ আর কান্নাজড়িত কন্ঠে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, পড়াশোনায় কখনও অমনোযোগী হবি না। ভালোমতো পড়াশোনা করবি। এ প্রসঙ্গে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, লেখাপড়া করে যে,গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে – কথাটি সবসময় মনে রাখবি। পন্ডিত স্যার আজ বেঁচে নেই। কিন্তু স্যারের কথা মনে পড়লেই হারিয়ে যাই স্মৃতির অতল তলে। দু’ চোখ মনের অজান্তেই ঝাপসা হয়ে আসে।