ঢাকা ০১:৫৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ বিজ্ঞপ্তী ::
সাপ্তাহিক যায় সময় পক্ষ থেকে লেখা আহবান

সিঙ্গাড়া সমাচার

  • আপডেট সময় : ০৬:১২:৫০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১ মে ২০২৪
  • / ১৮০ বার পড়া হয়েছে

সিঙ্গাড়া সমাচার

আবদুল মাজেদ

দৌলতদিয়া ফেরিঘাট থেকে পরিবহনের যাত্রীরা আরিচা ঘাটে পৌঁেছ পাক্কা দুঘন্টা অপেক্ষা করার পর গাবতলী থেকে নির্ধারিত বাস আসার পর যাত্রীরা পড়িমরি করে বাসে উঠে বসল। যাত্রীরা নির্ধারিত আসন গ্রহণ করতে না করতেই ফেরিওয়ালা বাসে উঠে গরম সিঙ্গাড়ার খবর শুনিয়ে দিল। তার বাজখাঁই গলার ঘোষণা না শুনলেও মো মো গন্ধ শুঁকেই অনুমান করা যেত যে বাসে সিঙ্গাড়া-ওয়ালা উঠেছে। তেল-মশলা-আলু-আটা-ময়দা একসাথে ভাজার পরে যে রসায়নটা তৈরি হতো তা থেকে বুঝার উপায় থাকতো না যে, তেলটা ভেজাল এবং মানসম্মত নয়। যাদের পরিপাকতন্ত্র যথেষ্ট ঘাতসহ তারা হয়ত বুঝত না, তবে গড়পড়তা পরিপাকতন্ত্রের অধিকারী মাত্রই এ সিঙ্গাড়া পেটে পড়ার পর বুঝতে পারত যে, স্বাদ-গন্ধ যাই হোক, জিনিসটা সুবিধের নয়।

যে সময়ের কথা বলছি, তখনও সংক্ষিপ্ততম দূরত্বের গোয়ালন্দ-পাটুরিয় ফেরিঘাট চালু হয়নি। সালটা ১৯৮৫ হবে। তখন দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চল থেকে ঢাকার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা হতো দৌলতদিয়া-আরিচা ফেরিঘাটের মাধ্যমে। ঈদের ছুটির পরে ঢাকাগামী যাত্রীদের ভিড় থাকলেও ঢাকা থেকে বহির্গামী যাত্রীর ভিড় তেমন একটা ছিল না। তাই খুলনা-যশোর থেকে পরিবহনের বাস যাত্রীদেরকে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে নামিয়ে ফিরতি যাত্রী নিয়ে চলে যেত। আমরা ঢাকাগামী যাত্রীরা পরিবহনের লঞ্চেই পদ্মা পার হয়ে আরিচায় নির্ধারিত বাসের অপেক্ষা করতাম। কিন্তু গাবতলী থেকে নির্ধারিত বাস সিডিউল মোতাবেক না আসায় দুই/তিন ঘন্টা খোলা আকাশের নিচে বসে থাকতে হতো। গাবতলী থেকে আরিচা পর্যন্ত পর্যাপ্ত সংখ্যক যাত্রী না পাওয়ায় আর্থিক লোকসানের ভযে দুই তিন ট্রিপের জন্য একটিই বাস বরাদ্দ থাকত। এহেন যাত্রী-হয়রানী পরিবহন মালিক ও কর্মচারিদের জন্য ছিল একটা বিনোদন। আর যাত্রীদের অবস্থা হতো কুয়োর মধ্যে দুরন্ত ছেলেদের ঢিলের আঘাতে জর্জরিত ব্যাঙের মত।

ঈদের পরে কর্মচারিরা এসে না পৌঁছনোর কারণে ফেরিঘাটের হোটেলগুলোও খুলত না। ফলে এক রকম না খেয়েই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে-বসে সময় কাটাতে হতো। ফেরিঘাটগুলোতে কোনো যাত্রী ছাউনি কিংবা যাত্রীদের বিশ্রামের জায়গা ছিল না। যদিও বা দুয়েকটি হোটেল খোলা হতো, কিন্তু পরিবেশ এতই জঘন্য ছিল যে, সেখানে খাওয়ার পরিবেশ ছিল না। আমি একবার বাথরুমের সন্ধানে এরকম একটা হোটেলের পিছনে গিয়ে দেখলাম প্রায় সাত আট হাত ব্যাসের একটি গর্ত। ঐ গর্ত দিয়ে মানুষের মল উপচে পড়ছে। এই ঘটনা দেখার পর থেকে আমি কামারখালি কিংবা আরিচা ফেরিঘাটে আর কিছু খাইনি।

তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করার পর যখন গাবতলী থেকে নির্দিষ্ট পরিবহন কোম্পানীর বাস এলো, তখন কালবিলম্ব না করে বাসে উঠে যার যার আসনে বসে পড়লাম। এই ক্ষুধা-তৃষ্ণার পর যখন সিঙ্গাড়াওয়ালা গাড়িতে উঠল তখন সবাই পড়িমরি করে কিনে সিঙ্গাড়া কিনে নিল। আমি অবশ্য কিনলাম না। কারণ, আমার পেটে সিঙ্গাড়া সয় না। সেটা অবশ্য সিঙ্গাড়ার দোষ নয়, সে জন্য আমার পেটের দোষ দেয়াই সমীচীন।

গাড়ীর পিছনের দিকের সিটে বসে ছিল দুজন সাদা চামড়ার বিদেশি। তারা ঠিক কোন্ দেশের তা বুঝে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ ইতঃপূর্বে বিদেশিদেরকে তেমন একটা দেখিনি। তাই তারা ইউরোপীয়ান না আমেরিকান তা বুঝার ক্ষমতা আমার ছিল না। তবে এতটুকুই দেখলাম, তাদের চামড়া সাদা, সৈয়দ মুজতরা আলীর ভাষায় ছেলা ওল। দুজনের একজন পুরুষ, আরেকজন নারী। বলা বাহুল্য তাদের মধ্যকার সম্পর্কও আমার পক্ষে অনুমান করা সম্ভব ছিল না।

সাভার ক্যান্টনমেন্ট পার হতে না হতেই পুরুষ লোকটি সুপার ভাইজারকে ডেকে গাড়ি থামাতে বলল। গাড়িও রাস্তার বাম দিকে থেমে গেল। তখন সাভার নবীনগর এলাকা এমন বিল্ট-আপ এরিয়া ছিল না। রাস্তার দুধারে শালবন, টিলা সদৃশ উঁচু মাটির ঢিবি আর রাস্তার পূবদিকে বিশ-পঁিচশ ফুট গভীর খাদ ছিল। খাদের ওপারেই দুয়েকটি কুঁড়ে ঘর, বড়জোর টিনশেড চোখে পড়ত। দুজন বিদেশীই খাদের ঢাল বেয়ে নেমে ওপারে তরতর করে উঠে গেল। খাদের ওপারে উঁচু জায়গায় একটা জীর্ণশীর্ণ কুঁড়ে ঘর, একটু দূরে খেজুরের পাতার ছাউনি দেয়া, শুকনো কলা-পাতায় ঘেরা কাঁচা পায়খানা। বিদেশী মহিলা কোনো রকমে পড়িমরি করে ঐ কাঁচা পায়খানায় ঢুকলো। তার হাতে ঘটি ছিল না বদনা ছিল ঠিক বুঝা গেলো না। তারমানে বাড়িটি হিন্দুবাড়ি না মুসলিম বাড়ি তা অনুমান করা গেলো না।

যাত্রীদের ভিতর আরেকবার হাসির তরঙ্গ খেলে গেল। খা সিঙ্গাড়া খা, ভেজাল তেলের সিঙ্গাড়ার কি মজা এবার দেখ।

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

সিঙ্গাড়া সমাচার

আপডেট সময় : ০৬:১২:৫০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১ মে ২০২৪

সিঙ্গাড়া সমাচার

আবদুল মাজেদ

দৌলতদিয়া ফেরিঘাট থেকে পরিবহনের যাত্রীরা আরিচা ঘাটে পৌঁেছ পাক্কা দুঘন্টা অপেক্ষা করার পর গাবতলী থেকে নির্ধারিত বাস আসার পর যাত্রীরা পড়িমরি করে বাসে উঠে বসল। যাত্রীরা নির্ধারিত আসন গ্রহণ করতে না করতেই ফেরিওয়ালা বাসে উঠে গরম সিঙ্গাড়ার খবর শুনিয়ে দিল। তার বাজখাঁই গলার ঘোষণা না শুনলেও মো মো গন্ধ শুঁকেই অনুমান করা যেত যে বাসে সিঙ্গাড়া-ওয়ালা উঠেছে। তেল-মশলা-আলু-আটা-ময়দা একসাথে ভাজার পরে যে রসায়নটা তৈরি হতো তা থেকে বুঝার উপায় থাকতো না যে, তেলটা ভেজাল এবং মানসম্মত নয়। যাদের পরিপাকতন্ত্র যথেষ্ট ঘাতসহ তারা হয়ত বুঝত না, তবে গড়পড়তা পরিপাকতন্ত্রের অধিকারী মাত্রই এ সিঙ্গাড়া পেটে পড়ার পর বুঝতে পারত যে, স্বাদ-গন্ধ যাই হোক, জিনিসটা সুবিধের নয়।

যে সময়ের কথা বলছি, তখনও সংক্ষিপ্ততম দূরত্বের গোয়ালন্দ-পাটুরিয় ফেরিঘাট চালু হয়নি। সালটা ১৯৮৫ হবে। তখন দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চল থেকে ঢাকার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা হতো দৌলতদিয়া-আরিচা ফেরিঘাটের মাধ্যমে। ঈদের ছুটির পরে ঢাকাগামী যাত্রীদের ভিড় থাকলেও ঢাকা থেকে বহির্গামী যাত্রীর ভিড় তেমন একটা ছিল না। তাই খুলনা-যশোর থেকে পরিবহনের বাস যাত্রীদেরকে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে নামিয়ে ফিরতি যাত্রী নিয়ে চলে যেত। আমরা ঢাকাগামী যাত্রীরা পরিবহনের লঞ্চেই পদ্মা পার হয়ে আরিচায় নির্ধারিত বাসের অপেক্ষা করতাম। কিন্তু গাবতলী থেকে নির্ধারিত বাস সিডিউল মোতাবেক না আসায় দুই/তিন ঘন্টা খোলা আকাশের নিচে বসে থাকতে হতো। গাবতলী থেকে আরিচা পর্যন্ত পর্যাপ্ত সংখ্যক যাত্রী না পাওয়ায় আর্থিক লোকসানের ভযে দুই তিন ট্রিপের জন্য একটিই বাস বরাদ্দ থাকত। এহেন যাত্রী-হয়রানী পরিবহন মালিক ও কর্মচারিদের জন্য ছিল একটা বিনোদন। আর যাত্রীদের অবস্থা হতো কুয়োর মধ্যে দুরন্ত ছেলেদের ঢিলের আঘাতে জর্জরিত ব্যাঙের মত।

ঈদের পরে কর্মচারিরা এসে না পৌঁছনোর কারণে ফেরিঘাটের হোটেলগুলোও খুলত না। ফলে এক রকম না খেয়েই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে-বসে সময় কাটাতে হতো। ফেরিঘাটগুলোতে কোনো যাত্রী ছাউনি কিংবা যাত্রীদের বিশ্রামের জায়গা ছিল না। যদিও বা দুয়েকটি হোটেল খোলা হতো, কিন্তু পরিবেশ এতই জঘন্য ছিল যে, সেখানে খাওয়ার পরিবেশ ছিল না। আমি একবার বাথরুমের সন্ধানে এরকম একটা হোটেলের পিছনে গিয়ে দেখলাম প্রায় সাত আট হাত ব্যাসের একটি গর্ত। ঐ গর্ত দিয়ে মানুষের মল উপচে পড়ছে। এই ঘটনা দেখার পর থেকে আমি কামারখালি কিংবা আরিচা ফেরিঘাটে আর কিছু খাইনি।

তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করার পর যখন গাবতলী থেকে নির্দিষ্ট পরিবহন কোম্পানীর বাস এলো, তখন কালবিলম্ব না করে বাসে উঠে যার যার আসনে বসে পড়লাম। এই ক্ষুধা-তৃষ্ণার পর যখন সিঙ্গাড়াওয়ালা গাড়িতে উঠল তখন সবাই পড়িমরি করে কিনে সিঙ্গাড়া কিনে নিল। আমি অবশ্য কিনলাম না। কারণ, আমার পেটে সিঙ্গাড়া সয় না। সেটা অবশ্য সিঙ্গাড়ার দোষ নয়, সে জন্য আমার পেটের দোষ দেয়াই সমীচীন।

গাড়ীর পিছনের দিকের সিটে বসে ছিল দুজন সাদা চামড়ার বিদেশি। তারা ঠিক কোন্ দেশের তা বুঝে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ ইতঃপূর্বে বিদেশিদেরকে তেমন একটা দেখিনি। তাই তারা ইউরোপীয়ান না আমেরিকান তা বুঝার ক্ষমতা আমার ছিল না। তবে এতটুকুই দেখলাম, তাদের চামড়া সাদা, সৈয়দ মুজতরা আলীর ভাষায় ছেলা ওল। দুজনের একজন পুরুষ, আরেকজন নারী। বলা বাহুল্য তাদের মধ্যকার সম্পর্কও আমার পক্ষে অনুমান করা সম্ভব ছিল না।

সাভার ক্যান্টনমেন্ট পার হতে না হতেই পুরুষ লোকটি সুপার ভাইজারকে ডেকে গাড়ি থামাতে বলল। গাড়িও রাস্তার বাম দিকে থেমে গেল। তখন সাভার নবীনগর এলাকা এমন বিল্ট-আপ এরিয়া ছিল না। রাস্তার দুধারে শালবন, টিলা সদৃশ উঁচু মাটির ঢিবি আর রাস্তার পূবদিকে বিশ-পঁিচশ ফুট গভীর খাদ ছিল। খাদের ওপারেই দুয়েকটি কুঁড়ে ঘর, বড়জোর টিনশেড চোখে পড়ত। দুজন বিদেশীই খাদের ঢাল বেয়ে নেমে ওপারে তরতর করে উঠে গেল। খাদের ওপারে উঁচু জায়গায় একটা জীর্ণশীর্ণ কুঁড়ে ঘর, একটু দূরে খেজুরের পাতার ছাউনি দেয়া, শুকনো কলা-পাতায় ঘেরা কাঁচা পায়খানা। বিদেশী মহিলা কোনো রকমে পড়িমরি করে ঐ কাঁচা পায়খানায় ঢুকলো। তার হাতে ঘটি ছিল না বদনা ছিল ঠিক বুঝা গেলো না। তারমানে বাড়িটি হিন্দুবাড়ি না মুসলিম বাড়ি তা অনুমান করা গেলো না।

যাত্রীদের ভিতর আরেকবার হাসির তরঙ্গ খেলে গেল। খা সিঙ্গাড়া খা, ভেজাল তেলের সিঙ্গাড়ার কি মজা এবার দেখ।