এটা আসলেই মিরাকেল
শাহ সাবরিনা মোয়াজ্জেম
মা বলতেন, রাত দিন পড়াশোনা কর তাহলে আর অর্কমণ্য হয়ে থাকতে হবেনা। কারণ টিফিন পালানো ছিলো আমার নিত্য স্বভাব। এতো বড় দিনের স্কুল এতো ক্লাস আর যতিলাল স্যারের বেতের বাড়ি সহ্য করা দায়। কারণ যতিলাল স্যার আমাদের গ্রামে হিন্দু পাড়ায় বাড়ি। আম্মাকে খুব ভালো চিনতেন। আমি টিফিনের আগের ক্লাস গুলোতে পড়া দিতাম কিন্তু যতিলাল স্যারকে দেখলেই আমি পড়া ভুলে যেতাম। হয়তো কাঠ-পেন্সিলের মাথা ভেঙে ফেলতাম, রাবার ঢিল ছুঁড়ে স্কুল সংলগ্ন পুকুরে ফেলে দিতাম নয়তো টিফিন পিরিয়ডে নেই হয়ে যেতাম। কিন্তু এতো কিছু করেও শেষ রক্ষা হতোনা। যাওয়ার পথে যতিলাল স্যার আম্মাকে নালিশ করে যেতেন। স্কুলে স্যার বাড়িতে মায়ের শাসন। জীবন অতিষ্ঠ। তখন মনে মনে ভাবতাম, এরশাদ সরকার মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ ঘোষণা করলেই তো পারে। মেয়েদের এতো পড়াশোনা কেনো। ওমা শুনি চাচাতো বোন আনোয়ারা আপা বিসিএস টিকে গেছে! আমার মাকে আর পায় কে? অনেক বাঁশের কঞ্চি এনে বেত বানাতে লাগলো। কিন্তু আমি পড়াশোনা বাদ দিতে পারি কিন্তু খেলা বাদ দিতে পারিনা পারবোনা মা যতো পারুক মারলে মারুক! সেদিন ইচ্ছে হলো শরবত বিক্রি করবো! কারণ আম্মা শাহাজীবাজার ( হবিগঞ্জ) গেছে মামার বাড়িতে। সকালে গেছে সন্ধ্যা নাগাদ চলে আসবে। ইসবগুলের ভুসি আর তুকমা কিনে নিয়ে শরবত বানালাম সাথে সেকারিন দিলাম। পথের ধারে বাড়ি আমাদের। একটা ভাঙাচোরা টেবিল আর ছোট ছোট গ্লাস নিয়ে দেরারছে চার আনা গ্লাস শরবত বিক্রি করছি। আমার ক্রেতা আমার মতো খুঁদে শিশুই! সেদিন স্কুলে যাইনি। বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পথে যতিলাল স্যার দেখলেন। তিনি গ্লাস গুলো ভেঙে দিলেন। আমার কাছে বিক্রির টাকা গুলো চাইলেন, দিলাম। জিজ্ঞেস করলেন, তোর মা কোথায়? বললাম হবিগঞ্জ গিয়েছে। এদিকে স্কুলে গেলে স্যার মারবে। আর মার এতো যত্নের সিন্দুকে ঢোকানো গ্লাস চারটি ভেঙে দিলেন। আর টাকা গুলো না হয় বাদই দিলাম! তিন টাকা পুঁজি খাটিয়ে বিশ টাকা বিক্রি করেছি! কাঁদছি শুধু গ্লাস গুলোর জন্যে! পরের দিন স্যার স্কুলে যাওয়ার পথে আমাকে সাথে নিয়ে গেলেন আর আম্মার কাছে বিশ টাকা দিয়ে গেলেন। গ্লাস ভাঙার কথা স্যার বলেননি আমিও চেপে গেলাম। তারপর প্রায় বিশ বছর পর — ততোদিনে যতিলাল স্যার হেড টিচার হয়ে গত হয়েছেন। আমিও সেদিনের সাত বছরের শিশু দুবাচ্চার মা হয়েছি! বিসিএস পাস করেনি কিন্তু পড়াশোনা করেছি পর্যাপ্ত! স্যারের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা কারণ ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত স্যার আমাকে গাইড করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আদতে তা ছিলো শুন্যের ঘরে। কারণ আমি চঞ্চল ছিলাম খুব তাই প্রাইমারিতে আমার কোনো অবদানই নেই! নেই তো নেই, মানে জীরো! দরজায় ঠোকা আবার কলিংবেল বাজছে। দরজা কাজের সহকারী দরজা খুলে দিলো। প্রথম দেখাতে চিনতে পারিনি। বলে, আমি মুনকি বাড়ি সরাইল। ওহ যতিলাল স্যারের মেয়ে? জ্বি দিদি। সাথে স্বামী নিয়ে আসছে। আরে এসো এসো… বসো। প্রথমে নাস্তা দিলাম তারপর তাড়াতাড়ি রান্না বান্না করে খেতে দিই। সে ভীষণ বিপদে পরে আমার কাছে এসেছে। তার স্বামী এমপিও ভুক্ত কলেজের প্রফেসর রাজনৈতিক কারণে সে এখন বহিষ্কার অবস্থায় আছে। কি করা লাগবে। দিদি এটা করলে ভালো হয়,ওটা করলে ভালো হয়। ঠিক আছে সব করা হবে। তুমি নিশ্চিন্তে বাসায় যাও নয়তো আজ থেকে যাও আগামীকাল সমস্যা সমাধানের চেষ্টা নিশ্চয়ই করা হবে। মুনকির স্বামীর জন্যে চেষ্টা তদবির যা যা লাগে আমার স্বামী সব করে দিলো। হা মুনকির স্বামী আবার বহাল তবিয়তে তার কর্মস্থলে ফিরে যেতে পেরেছিলো। এখনো ওখানেই আছে। মুনকিও বর্তমানে শিক্ষকতা ই করছে মনেহয়! জীবনে কার নাও কার ঘাটে ভীড়ে তা আল্লাহ তালা ভালো জানেন। নয়তো আমিও চাঁদপুর পোস্টিংয়ে যাবো, আর মুনকির বিয়ে হবে চাঁদপুরে। মুনকি আমার কাছে যাবে এটা আসলেই মিরাকেল ব্যাপার ছিলো। কারণ মুনকি ডাবল স্টার পাওয়া মেয়ে সে জীবনে এসে এতো লস হবে কেনো? ছাত্র জীবনে কখনোই মুনকির সাথে আমার কথা হয়নি আর আমি চাঁদপুর আছি বা ভালোভাবেই আছি মুনকি কি করে জেনেছে তা আজ আর মনে নেই! যতিলাল স্যার আমার প্রতি কেয়ার করতেন। আর আমিও তার মেয়ের ভালো কিছু করতে পেরে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম সেদিন। ইচ্ছে ছিলো একদিন মুনকির বাড়ি যাই কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে যাওয়া হয়ে উঠেনি কোনোদিন। মুনকির জন্যে আজীবন দোয়া রইলো আমার। সেই বাণীই চিরন্তন সত্য ” as u sow… so shall u reap” শাহ সাবরিনা মোয়াজ্জেম